– স্যার!
– হ্যা, বল।
– আপনার নাম সাজ্জাদ রাখা হল কেন, স্যার?
সিনথির এই প্রশ্নে অনেকটা ভড়কে গেছে অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী এবং গৃহশিক্ষক সাজ্জাদ হোসেন। সাজ্জাদ হোসেন নিজেও জানে না তার নাম কেন সাজ্জাদ রাখা হল না। সিনথি এখন কেমিস্ট্রির পর্যায় সারণি পড়ছে। এই চ্যাপ্টারটা মেয়েটার মনে হয় না পছন্দ হয়েছে। এই অধ্যায় পড়ানো শুরু করার পর থেকে তার মতিগতি ভাল ঠেকছে না। সিনথিকে এখন ক্যালসিয়ামের পর্যায় এবং গ্রুপ নির্ণয় করতে দেয়া হইছে। সাজ্জাদ লক্ষ করে দেখল, মেয়েটা 1s22s6 লিখে বসে আছে।
এখন মাথা নিচু করে দাত দিয়ে কলম কামড়াচ্ছে। সাজ্জাদের মেজাজ কিছুটা খারাপ হয়ে গেল। দুইটা পয়সার জন্য টিউশনি করতে এসে এত কাহিনী কেচ্চা শুনতে ভাল্লাগে? ফাজিল মেয়ে, তোমাকে যা করতে দেয়া হইছে তা না করে তুমি সাজ্জাদ হোসেন নিয়া গবেষণা করা শুরু করছ। আজকালকার ছেলেমেয়েগুলা এমন কেন? মনে মনে এসব ঝাড়ি ছাড়তে ছাড়তে সাজ্জাদ আবার শুনল, স্যার কি হল? বললেন না তো আপনার নামের ইতিহাস!
সাজ্জাদ মাথা ঠান্ডা করে উত্তর দিল, “আমি জানি না ঠিক। যতদুর জানি আমার চাচী এই নাম দিয়েছিলেন”।
আমার নামের পেছনে অনেক লম্বা গল্প আছে। শুনবেন স্যার? এই প্রশ্ন করেই সিনথি গল্প বলা শুরু করল। মেয়েরা তার কাছের বান্ধবীদের টিফিনের ফাঁকে পেলে যেমন গল্প ফাঁদে ঠিক তেমন করে বলতে লাগল। সাজ্জাদ দাতে দাত চেপে বলল,সে গল্প আরেকদিন হবে। এখন আমরা পর্যায় সারণি নিয়ে কথা বলি? হুম?
– দেখি ক্যালসিয়ামের গ্রুপ ও পর্যায় বের করেছ কিনা? সিনথি এইখানে তো কিছুই হয় নি! তুমি এই অধ্যায়টা বুঝতে পারছ না এবং সবচে দুঃখজনক ব্যাপার হল তুমি অমনযোগী।
– স্যার আমার কেমিস্ট্রি পড়তে ভাল লাগে না। পর্যায় সারণি তো একদমই না। বিশ্রী কিসব লেখা!
তা বুঝলাম। কিন্তু ভাল না লাগলেও পড়তে হবে। আমরা অনেক কাজই করি যা আমাদের ভাল লাগে না, কিন্তু না করে উপায় নেই। তাই নয় কি? দেখো, এই অধ্যায়টা অনেক সহজ এবং খুব সহজে বুঝা যায়।
আমি তোমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি আরেকবার। মনোযোগ দিয়ে দেখ।পর্যায় সারণি হল সহজ ভাষায় একটা তালিকা বা ছক… নিজের স্বভাবসুলভ উপায়ে ব্যাপারগুলো পরিস্কার করে বুঝাতে লাগল সাজ্জাদ।
সিনথি সাজ্জাদ স্যারকে মুগ্ধ হয়ে শুনছিল। হঠাত প্রশ্নে উত্তর দিল-জি স্যার।
প্রথমে তোমাকে ক্যালসিয়ামের যে প্রশ্নটা লিখতে দিয়েছিলাম, ওই প্রশ্নের উত্তরও কিন্তু ইলেক্ট্রন বিন্যাসে আছে। সাজ্জাদ স্যার তার মত করে বলতে লাগলেন,ইলেক্ট্রন বিন্যাস কিভাবে হয়, 1s2 এর পরে 2s6 না হয়ে কেন 2s2 হয়, পর্যায় কিভাবে আসে, গ্রুপ কিভাবে নির্ণয় করতে হয়, প্রথম সারিতে দুইটা মৌল কেন রাখা হয়, দ্বিতীয় সারিতে কেন আটটা এবং ইত্যাদি ইত্যাদি।
– স্যার!
– হু।
– এবার মনে হয় পারবো।
– না পারার তো কিছু নেই। বুঝলে সবই সোজা। আমাদের মাথায় রাখতে হবে টার্মগুলো বুঝা, নট মুখস্ত করা। ঠিক আছে?
– জি আচ্ছা।
সিনথিকে পড়াতে গেলে পড়ার গেলে সাজ্জাদ স্যারের মাঝে মাঝে নিজেকে দার্শনিক মনে হয়। তখন তিনি জীবন সম্পর্কে নানান কঠিন-তাত্ত্বিক কথাবার্তা বলা শুরু করেন। খুব যে গভীর দর্শন – সেরকমটি নয়। জীবন সম্পর্কে ওর নিজস্ব উপলব্ধির দু-একটা হয়ত মাঝে মধ্যে বলার চেষ্টা করেন। ওর আরও দুইটা টিউশনি আছে এমন। ওখানে এসব নিয়ে কথা হয় না। তবে কেন জানি, সিনথিকে সহজ কিছু হিসেব শেখাতে ভাল লাগে ওর। খুব বেশি বলতে গিয়েও বলেন না। এই বয়সের মেয়েছেলেরা কাগুজেকথা শুনতে পছন্দ করে না। খুব স্বাভাবিক হিশেব। সাজ্জাদ স্যারও নিজের ওই বয়সটাতে এসব শুনতে পছন্দ করতেন না।
সাজ্জাদ স্যার খুব ক্লান্ত। টিউশনি শেষ করে ঘরে ফিরতে ফিরতে ও চিন্তা করছে, প্রকৃতির মাঝে কত মিল! নিজের ভেতরের দার্শনিক স্বত্বাটা এসময় কেমন জানি জানান দেয় ভেতর থেকে। সাজ্জাদ ভাবছে – আমাদের সমাজেও কিন্তু নিঁখুত একটা সারণি আছে। এই সমাজেও একটা অলিখিত নিয়ম মেনে কতগুলো শ্রেণীতে মানুষকে সাজানো। একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ের মানুষের সাথে আরেক পর্যায়ের মানুষের অনেক ফাঁরাক-অনেক দূরত্ব। সমধর্মী মানুষগুলো নিজেরা আলাদা আর নানা অনুসঙ্গের নিরীখে মানুষ নিজেদের মাঝে দেয়াল টেনে বসবাস করে চলেছে। এই নিয়ম রসায়ন বইয়ের মত স্বীকৃত না হলেও এটা মানা হয় কঠিন নিয়মে।
সাজ্জাদ স্যার ভাবছেন, উনার যে সামাজিক অবস্থান, তাতে উনি সারণির কত নাম্বার মৌল হবেন? এই হিসেব ঠিক মিলছে না। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার। সংসারের নানান অভাব অনটন আর টানাপোড়নের প্রতিদিনকার জীবন। ঠিকমতো বাড়ি বাড়ি গিয়ে এই কামলা না দিলে না খেয়ে মারা পড়তে হবে। জীবনের যে কতটা কাঠিন্য যে কি সিনথি বুঝে! সাজ্জাদের মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় নিজের জীবনের গল্পগুলো তিনি একদিন সিনথিকে বলবেন। মুগ্ধ হয়ে শোনার মত একজন শ্রোতা প্রত্যেক মানুষের নিশ্চয়ই থাকা উচিত। প্রত্যেকটা মানুষের একটা নিজের মানুষ থাকা লাগে। যার কাছে হারা যায়, যে কখনো কখনো জেতার জন্য সাহস হয়ে আমাদের হাতটুকু আঁকড়ে ধরে। এমন মানুষ আছে ক’জনার? সাজ্জাদের মাঝে মাঝে নিজেকে খুব ক্লান্ত মনে হয়। খুব ইচ্ছে হয় নিজের অসহায়ত্বের গল্পটা, টিকে থাকার কথাগুলো সিনথিকে বলবেন। বলা হয়ে উঠেনা। একটা নিজের মানুষ, একটা ঘর, একটা সংসারের আশায় প্রতিদিন উঠোনে পা ফেলে ছেলেটা।