রাষ্ট্রের চরিত্র চিনে নেওয়ার এবং সেটাকে মুখস্ত, ঠোটস্থ এবং অন্তঃস্থ করার এখনি মোক্ষম সময়। আমরা যারা মনে করতাম, যত কিছুই হোক আমাদের এই দেশটিতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একটা দল আছে, কিছু মানুষ আছে যারা স্টেরিওটাইপ সীমারেখার বাইরে গিয়ে একাত্তরকে লালন করবে, মুক্তির জন্য লড়াই করবে; সেটি এখন সাক্ষাৎ ভুল প্রমাণিত হচ্ছে প্রতিদিন। তেরোর পরের বাংলাদেশ তো এসবেরই প্রমাণ দেয়। দুখের কিংবা অনুতাপের জায়গাটা হলো – আমরা যারা এদেরকে বিশ্বাস করতাম, মনে করতাম যত কিছুই হোক মুক্তি আসবে একদিন; সেই বিশ্বাসের জায়গাটা আর টিকে থাকলো না, আগের তুলনায় আরেকটু শক্তিশালী হতাশার জালে আটকে পড়ছি আমরা।
তীব্র এই রাষ্ট্রীয় সংকটের জন্য আমাদের ভালোবাসার আদরের সরকার যখন নেংটোভাবে দায়ী হয়, তখন এই বিশাল তরুণ সমাজের সত্যিকার অর্থে কোথাও ঠাই হয় না। তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যিত, পরাজিত এবং অপমাণিত হয়ে এরা হতাশ হয়, মুষড়ে পড়ে। রাষ্ট্র অত্যন্ত সচেতনভাবে এই হতাশকরণ ডিমোরালাইজিং প্রক্রিয়া বলবত রাখছে। মনে করছে মানুষগুলোকে, কণ্ঠস্বরগুলোকে, হাতগুলোকে যদি গুটিয়ে রাখা যায়, তাহলে বুঝি আর কোন সমস্যা থাকছে না। তারা আরো একটা দুটো বা তিনটে সফর টিকে থাকতে পারবেন। কিন্তু টিকে থাকার জন্য এই যে অন্যায় অশ্লীল নেংটো অবস্থান এর পরিণতি অতি ভয়াবহ। পুরো দেশ দিয়ে এর প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় কিনা সে উপরওয়ালা জানেন।
আমার মনে হয়, দেশের গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া খুব বেশী সংখ্যক মানুষ এখন আর বিভ্রান্ত নয়। দেশের কৃষক সমাজ রাষ্ট্রকে চিনতে শিখেছে, শ্রমিক সমাজ রাষ্ট্রকে চিনতে শিখেছে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা জানে কি হচ্ছে না হচ্ছে, হাজার হাজার তরুণও একদমই বিভ্রান্ত না, নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত শ্রেণীও সব জানে ও বুঝে। কেউই এখন আর অবুঝ নাই। পথে পথে ফ্লাইওভার গড়ে দেওয়া আর শহর-গঞ্জের মোড়ে মোড়ে নিবন্ধনযজ্ঞ চালিয়ে উন্নয়ন আর ডিজিটালাইজেশনের যে লোক দেখানো আয়োজন, সেটিতে মানুষ খুশিতে নয়ই বরং স্বল্পমাত্রায় বিরক্তও। প্রশ্ন হল বিভ্রান্ত আসলে কারা? আমার মনে হয় – বিভ্রান্ত আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা, বুদ্ধিজীবীরা আর কিছু স্পাইনলেস কবি আর আর্টিস্টরা। উনাদের কালি নাই, কলম নাই, কন্ঠ নাই, চক্ষু নাই। উনারা বিশ্ববিদ্যালয় কইরা টাকা পান, টকশোতে দুচার পয়সা পান, এদিক ওদিক থেকে কিছু পান; কোন না কোনভাবে উনাদের দিব্যি চলে যায়। উনাদের মৌলবাদের জুজু পেয়ে বসেছে। উনাদের জন্য একটি মঞ্চ আছে, সে মঞ্চে উনারা মুক্তিযুদ্ধ আর মৌলবাদ নিয়ে কথা বলেন। উনারা মনে করেন, এই সরকারের ভুলগুলো নিয়ে যদি উনারা কথা বলেন, যদি সরকার কোন কুক্ষণে ক্ষমতা হারায়; তাহলে উনাদের মঞ্চটা টিকে থাকবে না। উনারা এদিক ওদিক হারিয়ে অকুল দরিয়ায় ঠাইহারা হবেন। অপর একটি দল ক্ষমতায় আসবে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কন্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে যাবে, জঙ্গিবাদ মাথাছাড়া দিয়ে উঠবে এবং সমাজে উনাদের শান্তিপূর্ণ এবং নিরাপদ জীবনযাপন ব্যহত হবে।
যখন শিক্ষক হত্যার প্রতিবাদে উনাদের মৌন অবস্থান দেখি, প্রতিবাদী মানুষের কন্ঠস্বর রুদ্ধ করে দেয়ার সময়ে যখন উনারা দিনের পর দিন চুপচাপ বসে থাকেন, তখন উনাদেরকে বিশ্বাস করার আর কি কোন জায়গা থাকে? আমরা যারা অধ্যাপক জাফর ইকবাল স্যারের লেখাসহ মুক্তিযুদ্ধের নানান আবেগকে ঘিরে বড় হয়েছি, মুক্তিযুদ্ধকে চিনেছি, আমাদের মন খারাপ করার জায়গাটা এখানে বোধ হয়। লড়াই সংগ্রামের গল্প শুনিয়ে, নতুন দিনের স্বপ্ন দেখিয়ে; উনারা আমাদের সুখ কেড়ে নিয়েছেন।
বিভ্রান্ত মানুষদের বিভ্রান্তি কেটে উঠুক। রাষ্ট্রের চরিত্রটুকু উনাদের জানা খুব বেশী প্রয়োজন।
-
Previous
Tricks on array index range query -
Next
Multiplication of Two Big Numbers (more than 100 digit)