বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা এসিএম আইসিপিসির চূড়ান্ত পর্বের মূল প্রতিযোগিতা আজ অনুষ্ঠিত হলো। এবারের আয়োজন হয়েছে থাইল্যান্ডের পুকেট শহরে। এটি ছিলো এসিএম আইসিপির ৪০ তম আসর। আয়োজক বিশ্ববিদ্যালয় থাইল্যান্ডের প্রিন্স অব সংকলা ইউনিভার্সিটি। চূড়ান্ত পর্বের আগে লক্ষ লক্ষ প্রোগ্রামারদের মাঝ থেকে সেরাদের বাছাই করার উদ্দেশ্যে বিশ্বের নানা রিজিওনজুড়ে আয়োজিত হয়েছিল রিজিওনাল প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা। ১০২ টি দেশের মোট ২৭৩৬ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৪০০০০ প্রতিযোগী রিজিওনাল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিল। সেখান থেকে বাছাই প্রতিযোগিতার ধাপ পার হয়ে বিভিন্ন দেশের মোট ১২৮ টি দল ওয়ার্ল্ড ফাইনাল ২০১৬ মানে চূড়ান্ত পর্বে লড়াই করার জন্য যোগ্যতা অর্জন করে। বাংলাদেশ ঢাকা রিজিওনের অন্তর্ভুক্ত এবং এই রিজিওন থেকে এবছর ০৩ টি দল ওয়ার্ল্ড ফাইনালে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। এবারের আইসিপি নিয়ে বাংলাদেশে উচ্ছ্বাস আর উদ্দীপনা ছিলো অন্যমাত্রায়।
দীর্ঘ সাত বছর পরে আবারো বাংলাদেশ থেকে ০৩ টি দল ওয়ার্ল্ড ফাইনালে অংশ নিয়েছে। অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়। এর মাঝে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহজালাল বিশ্বিবদ্যালয়ের বর্তমান দলদুটি গতবারের আইসিপিতেও অংশ নিয়েছিলো।
আজকের কন্টেস্টে প্রবলেম ছিলো ১৩ টি। এবারের প্রব্লেমসেট আইসিপিসির ইতিহাসের কঠিনতম প্রব্লেমসেট বলা যেতে পারে। ১৩ টি সমস্যা সমাধানে লক্ষ্যে পাঁচ ঘন্টা ধরে চলছিলো এই মেধাযুদ্ধ। বিশ্বের নানান বাঘা বাঘা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোড় মেধাবী ও পরিশ্রমী তরুণদের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের র্যাঙ্কলিস্টে পুরো ০৫ ঘন্টা জুড়েই ছিলো নানান নাটকীয়তা। রাশিয়া, আমেরিকা ও চীনের বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয় শুরু থেকেই র্যাঙ্কলিস্টের উপরের দিকে ছিলো। সব নাটকীয়তা শেষে সর্বোচ্চ ১১ টি সমস্যার সমাধান করে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ স্টেট ইউনিভার্সিটি। চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্যরা হলেন Alexey Gordeev, Igor Pyshkin Stanislav ও Stanislav Ershov। চ্যাম্পিয়ন দলের কোচ হলেন – Andrei Lopatin। প্রতিযোগিতার দ্বিতীয় অবস্থানে দখল করে চীনের Shanghai Jiao Tong University। রানার্স আপ দলও চ্যাম্পিয়ন দলের সমান সংখ্যক সমস্যা সমাধান করতে সমর্থ হয়। চ্যাম্পিয়ন ও রানার্স-আপ দলের টাইম পেনল্টি ব্যাবধান হচ্ছে মাত্র ০৭ মিনিট। ১০ টি সমস্যার সমাধান করে আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় তৃতীয় স্থান দখল করে। মস্কো ইন্সটিটিউট অফ ফিজিক্স অ্যান্ড টেকনোলজি চতুর্থ। প্রতিযোগিতার নিয়ম অনুযায়ী প্রথম ০৪ টি দল স্বর্ণ পেয়ে থাকে। পঞ্চম থেকে থেকে অষ্টম দল পায় রোপ্য। আর নবম থেকে দ্বাদশ দল পায় ব্রোঞ্জ। সবমিলিয়ে শীর্ষ দশে রাশিয়া, চীন ও আমেরিকার তৃদেশীয় রাজত্ব ছিলো দেখার মতো । এবারই প্রথম আমেরিকার দুটি দল প্রথম ১০ টি অবস্থানের দুটিতে জায়গা করে নিতে সমর্থ হয়। একক আধিপত্য বজায় রেখে শীর্ষ দশে ইউরোপের মোট ০৭ টি দল জায়গা করে নেয় আর চীনের ছিলো মাত্র ০১ টি দল। র্যাঙ্কলিস্ট ফ্রোজেন হওয়ার আগ পর্যন্ত জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান বেশ ভালো ছিলো কিন্তু শেষ ঘন্টায় খুব একটা সুবিধা করতে না পারায় এবং একটা রং সাবমিশনের কারণে ১৪ তম অবস্থান নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হল।
বাংলাদেশের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের JU_O(N^3) দল ০৬টি সমস্যার সমাধান করে ৫০ তম হয়। বাংলাদেশের জন্য নিঃসন্দেহে এটি চমৎকার একটি অর্জন। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রত্যেকেই দুটি করে সমস্যার সমাধান করে যথাক্রমে ১১১ ও ১১৩ তম স্থান অর্জন করে। র্যাঙ্কলিস্ট ফ্রোজেন(শেষ ঘণ্টার আগে, চার ঘন্টা শেষ হলে র্যাঙ্কলিস্ট ফ্রোজেন করে দেয়ার নিয়ম রয়েছে) হওয়ার আগ পর্যন্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সমাধান করে ০৩ টি। পরবর্তী ০১ ঘন্টায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় দুর্দান্ত খেলে এবং আরো ০৩ টি সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হয়। সাস্ট ও এনএসইউ-এর শেষ ঘন্টায় কোন সঠিক সল্যুশন হয়নি। এবারের প্রবলেমসেট যথেষ্ট কঠিন হলেও সমালোচকদের মতে, সাস্ট ও এনএসইউ-এর আরো ভালো করার সুযোগ ছিলো।
গতবারের মতো এবারও আমরা ভারতের থেকে এগিয়ে আছি। প্রথম ৫০ টি দলের মধ্যে আমাদের একটি দল রয়েছে। অন্যদিকে ভারতের ০৫ টি দল এবারের আইসিপিসিতে অংশগ্রহণ করেছিল এবং কোন দলই প্রথম ৫০ এর মধ্যে জায়গা করে নিতে পারিনি। ভারতীয় দলগুলোর র্যানলিস্টের ক্রম হল ৫৭, ৫৯, ৬১, ৬৬ ও ৭০। এর মাঝে ৫৭ তম স্থানটি ছিলো Indian Institute of Information Technology – Allahabad এর দখলে এবং ৫৯ তম স্থান দখল করে Indian Institute of Technology – Delhi। সবচে মজার বিষয় হল হোস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিলো র্যাঙ্কলিস্টের একদম তলানিতে মানে ১২৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝে Prince of Songkla University মাত্র ০১ টি সমস্যার সমাধান করে সর্বশেষ স্থান দখল করে।
আগামী বছরের ওয়ার্ল্ড ফাইনালের ভেন্যু রীতিমত ঘোষণা করা হয়েছে। আমেরিকার সাউথ ডাকোটাতে হবে আগামী বারের ওয়ার্ল্ড ফাইনাল। সবচে আনন্দের বিষয় হল আগামী আইসিপিতে প্রথমবারের পাইথনকে প্রবলেম সলভিং ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে ডিক্লেয়ার করা হয়েছে। পাইথন প্রোগ্রামারদের মধ্যে এ নিয়ে বিরাট উল্লাস ও ঈদের আমেজ লক্ষনীয়।
এসিম আইসিপি ২০১৬ শেষ হল। খুব দ্রুতই বাংলাদেশের প্রতিযোগিতারা ফিরে আসবেন। এখন পর্যন্ত এসিএম-এ আমাদের অর্জন মন্দ নয়। অন্যান্য দেশের আইসিপি নিয়ে যে আয়োজন ও উদোগ সে তুলনায় বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে। তবুও বুয়েটের কায়কোবাদ স্যার, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবুল হক স্যার, সাউথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহরিয়ার মঞ্জুর স্যারসহ আরও অনেক শিক্ষক ও প্রাক্তন এসিম প্রোগ্রামারদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় বেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে দুটি আলাদা রিজিওন করার ব্যাপারে কিছুটা সম্ভাবনা তইরি হচ্ছে। সারা বছরব্যাপী নানান জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার আয়োজন চলছে। এ বছর চালু হয়েছে স্কুল পর্যায়ে প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা। আমাদের প্রতিযোগীরা অন্যান্য দেশের তুলনায় কোন অংশেই কম নয়। উপযুক্ত সুযোগ পেলে নিশ্চয়ই আমরা একদিন চ্যাম্পিয়ন হতে পারবো। তার সাথে কিছু স্বর্ণ, রোপ্য দেশের জন্য নিয়ে আসতে পারবো বলে আশা করা যেতেই পারে। ২০১৭ আইসিপিতে আমাদের অর্জন আরো ভালো হোক এ প্রত্যাশা রইল।
- কন্টেস্টের পূর্ণাঙ্গ র্যাঙ্কলিস্ট – http://myicpc.icpcnews.com/World-Finals-2016/scoreboard
- অংশগ্রহণকারী দলগুলোর তথ্য ও কোডফোর্সের প্রোফাইল – http://codeforces.com/blog/entry/22055
- ২০১৬ ওয়ার্ল্ড ফাইনালের প্রব্লেমসেট পাওয়া যাবে এই ঠিকানায় – https://icpc.baylor.edu/worldfinals/problems/icpc2016.pdf
- নানান সময়ের ওয়ার্ল্ড ফাইনালস চ্যাম্পিয়নদের তথ্য পাওয়া যাবে - https://icpc.baylor.edu/community/world-finals-champions
এসিম আইসিপি প্রতিযোগিতার বিস্তারিত নিয়ে কয়েকদিন আগে একটি ব্লগ লেখার চেষ্টা করেছি। আগ্রহীরা পড়ে দেখতে পারেন। লেখাটি পেতে এই লিঙ্ক দেখুন।
-
Previous
কম্পিটিটিভ প্রোগ্রামিং টিউটোরিয়াল লিঙ্কবাকসো -
Next
Quora: বর্তমান সময়ের সেরা প্রশ্ন-উত্তর সাইট