আমি সবসময় এই বিষয়টা নিয়ে আহত বোধ করি যে আমাদের তরুণদের, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে প্রাণশক্তিটুকু থাকবার কথা ছিলো সেটি এখন আর নেই। আমাদের তরুণরা হতাশ, ক্লান্ত এবং অশ্লীল স্থূল প্রতিযোগিতায় মত্ত কিংবা আমাদের করবার মতন, উৎসারিত হবার মতন কিছু আর দৃশ্যমান নয় আজ। ইতিহাস এবং দর্শনের দূর্বল এবং অমনোযোগী ছাত্রতে ভরে গেছে বাংলাদেশ। ষোল কোটি মানুষের এই গরিব দেশে শিক্ষা এবং বুদ্ধিভিত্তিক চর্চা একটা গুরুরত্বপূর্ণ কন্ট্রিবিউটিং ফোর্স হিশেবে কাজ করাটা সবসময় জরুরি ছিলো, আকাঙ্ক্ষিত ছিলো। সেটি দিনকে দিন রুগ্ন এবং ক্লান্তিকর হয়ে উঠছে। আমাদের নাগরিক জীবন যেভাবে প্রকাশিত হচ্ছে সেটি ঠিক আমাদের ভূখন্ডের জন্য উপযোগী নয়, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সঠিক পথে নেই, অকার্যকর, আমাদের শিক্ষকেরা ক্লান্ত এবং অযোগ্য, আমাদের তরুণেরা ভুল এবং কর্দমাক্ত, আমাদের রাজনৈতিক দর্শন বিপদজনক, জনবিরোধী, অনাধুনিক এবং ধংস্বাত্মক। এইযে আমাদের সামগ্রিক চিত্রটি ভুলেভরা এর পেছনে সবচে বড় কারণ আমরা যেখানে যেতে চাই, যেভাবে যেতে চাই, আমাদের গন্তব্য – মিসগাইডেড এবং করাপটেড। শুয়োর মাদাফাকা পাকিস্তান আমাদের বড় ক্ষতি করে গেলো। ১৪ ডিসেম্বর রাতে আমরা যা হারালাম তার একটা স্পষ্ট ছাপ দেশের গায়ে সেপটে গেছে।
আমাদের মতন গরিব দেশের লোকেদের দেশকে নিরন্তর ভালোবাসাটা অন্যদের চাইতে খুব বেশি জরুরি। সত্যিকার অর্থে এই ভূখণ্ডে দেশপ্রেমিক হওয়াটা উন্নয়নশীল যে কোন ভূখণ্ডের চে বেশি সংকটময় বলে আমি মনে করি। আমাদের চারপাশ মননশীল নয়, সুস্থ নয়, সুন্দর নয়। দারিদ্রতা, হটকারিতা, দূর্নীতি, বঞ্চনা, অভাব, অনটন আমাদের নিত্যকার উপাদেয় – এসব মাড়িয়ে সত্যনিষ্টতায় বেঁচে থাকা সহজ নয়, সাবলীল তো নয়ই। স্বাধীন এবং সুন্দর জীবনযাপন এখানে কণ্টকময়। এখানকার জীবন দ্বান্ধিক, বিভ্রান্তিকর এবং শ্রান্তিকর। এইযে সংকট – প্রতিদিনকার, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় টানাপোড়ন – এসবকে ছাড়ীয়ে যাবার জন্য অফুরান প্রাণশক্তি, আত্মমগ্নতা, তেজ, একরোখা আবেগের প্রয়োজন। প্রয়োজন গণতান্ত্রিক বোধের জাগরণ। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র, নৈতিক সক্ষমতা আর মানবিক মূল্যবোধ চর্চায় সামগ্রিক অংশগ্রহণ। কিন্তু এসব আজ নিরুৎসাহিত ভীষণ রকম।
তবুও আশার বিষয় এই যে, দৃঢ় প্রাণশক্তি অর্জনের এবং বয়ে চলবার মতন দূর্দান্ত ইতিহাস আমাদের আছে। বহু বছর আগে আমাদের সুবর্ণসন্তানেরা যেসব আমাদের জন্য অর্জন করে গিয়েছেন – এক ভয়াবহ, মর্মভেদী, রক্তাক্ত অর্জন। আমাদের ইতিহাস শক্তিশালী, সবুজ এবং দুর্বিনীত। আজ যারা আধুনিক, আজ যারা পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রন করছে, সেখাচ্ছে মূল্যবোধ আর মানবিকতা – তাদের চেয়ে আমাদের ইতিহাস কয়েকগুণ বেশি শক্তিশালী।
মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা আন্দোলন, ১৪ই ডিসেম্বর, ভাষা আন্দোলন এই সময়গুলো আমাদের এক গৌরবময় অধ্যায়, এক বাঁধভাঙা জীবনোচ্ছ্বাস আর মুক্তির গণ আন্দোলন, নির্জলা আবেগের সঞ্চারণ। আমরা যাই কিছু হয়ে উঠিনা কেন, আমাদের ফেরবার পথ ওইসব দিনে আঁকা আছে। আমরা যারা এই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে বড় হয়েছি, আমাদের শহরে, মফস্বলে, গ্রামে গঞ্জে যেসব ইতিহাস জমে আছে, বীরত্বগাথা, আত্মত্যাগ, মুক্তি আন্দোলন, মাটি আর মায়ের যে স্পর্শ, রক্তাক্ত দূর্বার এক ইতিহাস – এসবই পারে আমাদের মধ্যে সামনের দিকে তাকাবার শক্তি জোগাতে। আমি যখন মুক্তিযুদ্ধের দিকে তাকাই, এক দূর্বার তেজে ভেতরটা জ্বলে উঠে, ক্ষোভে ফেটে পড়ি, আন্দোলিত হই, উদ্বেলিত হই, হাহাকার আর যন্ত্রণায় কুকড়ে উঠি।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। আমাদের বড় কষ্টের আর বেদনার দিন আজ।
-
Previous
skipping classes, questioning, torture, problematic system and suicide -
Next
কিচ্ছু হইতেছে না