যতদিন পর্যন্ত একাডেমিক টেক্সটের মধ্যে আপনি সেক্স এডুকেশন না আনতে পারতেছেন ততদিন নাগাদ আপনি সতেরো কোটি জনগণকে নিয়ে আগাইতেছেন না। মানে বাচ্চারা কিন্তু এখনো সেক্স এডুকেশনটা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পাচ্ছে না কোথাও। মা বাবারা যে বইপত্র কিনে এনে ছেলেমেয়েদের শেখাবে অমন বইপত্রও খুবই কম। সবচে ইম্পর্ট্যান্ট আলাপ, বাংলা ভাষায় ভালো কয়টা সেক্স এডুকেশনের বই কিংবা বিজ্ঞান/দর্শনের বই এযাবত কাল পর্যন্ত লেখা হয়েছে? আমার জানামতে তো খুব একটা নাই। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু কাজ হচ্ছে অবশ্য। কিন্তু স্কুল কলেজে কি এগুলির উপর একাডেমিক কোর্স আছে, ইউনিভার্সিটিতে আছে? টিভিতে এগুলি নিয়ে সচেতনতা তইরি করা হচ্ছে কি নিয়মিত? অনলাইনে কি ঠিকঠাক বিস্তারিত আর্টিকেল আছে? ইউটিউবে কি এগুলি নিয়ে যথেষ্ট কন্টেন্ট আছে? নাই।
আমরা একটা ওপেন ইন্টারনেট সোসাইটিতে ডুইকা গেলাম হুট কইরা। আমাদের যৌনশিক্ষার এদিক ওদিক খেয়াল করা হয় নাই। নারী সেক্স অবজেক্ট ছাড়া অন্য কিছু যে হইতে পারে এইটা সমাজের লোকেদের কজন চিন্তা করবার পারে? দেশ ধর্মান্ধ কিংবা পুরুষতান্ত্রিক আগেও ছিলো; দিনকেদিন কম ধর্মান্ধ কম পুরুষতান্ত্রিকতার দিকে এগোচ্ছ – নাকি এগোচ্ছে না? নারীর প্রতি যৌন নিপীড়ন বন্ধে কি কি বিষয় আমাদের দরকার সেগুলো নিয়ে নানান আলোচনা আছে। সবার আগে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নারী এবং পুরষলোকদের যৌনশিক্ষার দিকে খেয়াল হবে। সমাজের বৃহৎ অংশের লোক এখনো এই বিতর্কই নিতে পারতেছে না যে – যৌন নিপীড়নের জন্য নারীর পোশাক/বেশভূষা দায়ী নয়। যৌন নিপীড়নকারীর মনস্তত্ত্ব নিয়ে স্টাডি করা দরকার এখন। নিপীড়নকারীইতো সবচে বেশি ভালো বলতে পারবে সে কেন এই অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে? সমাজের কোন এলিমেন্টগুলো নিপীড়নকারীকে সুযোগ করে দিচ্ছে সেটি জানাও দরকার। একইসাথে গত ৫/১০ বছরের যৌন নির্যাতনকারীদের তালিকা নিয়ে পরিসংখ্যান তইরি করা জরুরি এই অপরাধে সমাজের কোন অংশের মানুষ জড়িত হচ্ছে বেশি। সমাজের সব ক্ষেত্রেই নারীরা নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ আসতেছে। স্কুল, কলেজ, অফিসপাড়া, বিশ্ববিদ্যালয় – কোথায় না? নিপীড়নকারীরা ধর্ষণের পেছনে যে বিষয়গুলোকে কারণ হিশাবে দেখাচ্ছে সেগুলো পয়েন্ট আউট করাও দরকার। সেগুলিকে নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে এখন প্রচুর তর্ক বিতর্ক হচ্ছে। সোসাইটি ওপেন ইন্টারনেটের কারণে অনিয়ন্ত্রিত কালচারাল শকের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে কিনা সেটাও ভাবতে হবে। রিলিজিওন আর আধুনিক সমাজের দ্বান্দ্বিক অবস্থানতো একটা ইম্পর্ট্যান্ট আলাপ। মোল্লাদের ওয়াজ মাহফিল থেইকা যে নারীবিদ্বেষী বক্তব্য দেয়া হচ্ছে সেগুলি ভয়ানক ক্ষতিকর। আরেকটা প্রশ্ন হইলো সমাজের পুরুষরা কি সেক্সুয়াল ফ্রাস্টেটেড, ডিপ্রেসড? এই ফ্রাস্টেশন, ডিপ্রেশনের সল্যুশন কি হইতে পারে? পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে থামিয়ে রাখার জন্য নিপীড়ন একটা কি টুল হিশেবে ইউজ করার ব্যাপার আছে। তাহলে পুরুষতান্ত্রিক ধারণাগুলোর বিপরীতে জনসচেতনতা তইরির উদ্যোগ নিতে হবে। সভ্য সমাজে অপরাধ দমনের অন্যতম উপায় হচ্ছে আইনের সঠিক প্রয়োগ। গত ক বছরে ঘটে যাওয়া যৌন নিপীড়নের ঠিক কটির বিচার হয়েছে? অপরাধীরা কি রাজনৈতিক মদদে এই ধরণের অপরাধে লিপ্ত হচ্ছেন? উত্তরগুলি কি দাঁড়াইতেছে? সবুজ জমিনে নিথর পড়ে থাকা বিউটি আমাদের কি বলতে চায়? রাস্তাঘাটে ঘরে দুয়ারে বিশ্ববিদ্যালয় পাড়ায় নারীর প্রতি সহিংসতা এলার্মিং আঁকারে বেড়ে গেছে সাম্প্রতিক সময়ে। আমি মনে করি, দুটো বিষয় সবচে জরুরি এক সামাজিক সচেতনতা এবং যৌনশিক্ষার সুযোগ তইরি করা দুই অপরাধীকে রাষ্ট্রীয় আইনে শাস্তির বিধান করা।
আন্দোলনকারীদের এই দুটি বিষয়ে নজর দেয়া দরকার। পুরুষতান্ত্রিক নিপীড়নকারী সমাজ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কনস্ট্রাক্টিভ আন্দোলনে যেতে হবে। রাষ্ট্রীয় আইনের সঠিক প্রয়োগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্র কি নিপীড়নকারীদের আশ্রয়দাতা হিশেবে পরোক্ষ ভূমিকা পালন করছে না? আপনি সামাজিক মাধ্যমে এইগুলি নিয়ে লেখালেখি করলে আমি দেখি কিংবা আরো দুচারজন দেখেন। আমি আপনাকে দেখি কারণ আমাদের সোশ্যাল নেটওয়ার্ক গ্রাফে একটা পিয়ার কানেকশন আছে। এইগুলি থেকে সচেতনতা তইরি হয় কিন্ত সেটি মাস লেভেলে না। বরং সাম্প্রতিক সময়ে আমি দেখি দারুণ আকারে উগ্রতা আর বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে। একই সাথে তীব্র হতাশা ছড়ানো হচ্ছে যা আন্দোলনের জন্য মূলত ক্ষতিকর। একটা শক্তপোক্ত সিস্টেমকে ভাঙ্গনের জন্য অবশ্যই কনস্ট্রাকটিভ আন্দোলন এগিয়ে নিতে হবে। দীর্ঘমেয়াদী এবং সাস্টেইনেবল কৌশলে সমাজকে আঘাত করতে হবে।
আমার গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে পড়া বাচ্চাটা কিন্তু সেই বাপমা দাদাচাচা আর ইমাম সাহেবের বয়ান থেকেই শিখতেছে। তার কাছে সেক্স এডুকেশনটা ট্যাবুই। ওগুলি বড়দের বিষয় বলে তার জিজ্ঞাসাগুলোকে এড়ায়া যাওয়া হইতেছে কিংবা লুকানো হচ্ছে। শেখানো হচ্ছে ভুল। একটা মিসকনসেপশনের মধ্যে সে বড় হচ্ছে এবং সেটাকে কন্টিনিউ করতেছে। দেশের কতকোটি শিক্ষার্থীকে সেক্স এডুকেশন দেয়া হইছে এবং তার কত কোটি সঠিক শিক্ষাটা পাইছে – এর কোন পরিসংখ্যান আছে কি? কিচ্ছু হচ্ছেনা বলে চিৎকার চেচামেচির পাশাপাশি এবার পোলাপানের শিখবার জন্য কিছু বাংলা ভাষার রিসোর্স ডেভেলপ করার দিকে নজর দেয়া চাই। দেন সেগুলি এভেইলেবল করার বিশ/ত্রিশ বছর পর দেশ তান্ত্রিকতা মুক্ত হবার আশা করা যেতে পারে। আপনাকে আগে মানুষকে সঠিক জ্ঞান অর্জনের সুযোগটা দিতে হবে।
আমাদের স্কুলে ‘নিজেকে জানো’ নামে একটা বই ছিলো লাইব্রেরিতে। অই বই মেবি ব্র্যাক দিছিলো তখন। বইটা থেকে প্রচুর জিনিশ জানার সুযোগ হইছিলো সেই ক্লাস এইট নাইনে। অইটুকু জেনেছি বলেই পরবর্তীতে বিষয়গুলি আমার জন্য সহজ ছিলো অনেকখানি। জানবার জন্য পথ তইরি করলে সেপথে আগামী উঠে আসবে, আসতেই হবে। যৌনতা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পাড়ায় পর্যন্ত ভয়ানক ট্যাবু দেখতে পাই, এইসব ট্যাবু ভাইঙ্গা নিপীড়নমুক্ত সমাজ আজকাল পরশুই তইরি হইতেছে না। তাই নিপীড়নের যারা শিকার হচ্ছেন, তাদেরকে সমাজে সহজভাবে নিতে পারার ব্যাপারটিও খুব জরুরি।
এই বাংলাদেশ আমার না বলে বিষয়গুলোকে স্রেফ হতাশা প্রকাশ করা ভালো ব্যাপার না। বাংলাদেশ অবশ্যই একটা ধর্মান্ধ, ন-সেক্যুলার এবং পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্র এখন পর্যন্ত। এবং আজ থেকে ২০ বছর আগেও তা ছিলো। সতের আঠারো কোটি এদেশেরে একটি বিরাট অংশের জনগণ এখনো অশিক্ষিত, গোড়া ধার্মিক এবং তাদের চিন্তাভাবনা সনাতনী এবং পুরুষতান্ত্রিক। আমাদের সেক্যুলারিজম প্র্যাক্টিস অতোটা স্ট্রং হয়ে গ্রামে গঞ্জে শহরে ছড়ায় নাই। চর্চার ক্ষেত্রে কিছুটা আপসএন্ডডাউনস ছিল। একই সাথে আমাদের চর্চার ভেতর নৈতিক সক্ষমতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, স্বাতন্ত্র অবস্থান এগুলি অবহেলিত হয়ে আসছে শুরু থেকেই। আমাদের সন্তানের মা বাবারা অসচেতন এবং সন্তানদের সঠিক শিক্ষা দেবার উপযুক্ত পরিবেশ এখানে নেই। আপনি যদি সাম্প্রতিক নিপীড়নকারীরা কারা এই প্রশ্নটি মনোযোগ দিয়ে বিশ্লেষণ করেন তাহলে দেখবেন এইখানে ক্ষমতাশীল গোষ্ঠীর একটা সুস্পষ্ট ইনভলমেন্ট আছে।
মুলত এই বাংলা ভাষায় এখনো ঠিকঠাক দুইটা দর্শনের বই নাই, সেক্স এডুকেশনের বই নাই, ইউনিভার্সিটিতে কোর্স নাই, স্কুলে টেক্সট নাই। এইসব না থাকার উপর দাঁড়ায়া বুদ্ধিভিত্তিক সমাজ কিভাবে আশা করতে পারেন দেশের সামগ্রিক মুক্তি আসবে, নিপীড়ন কমে আসবে? এইযে ধর্ষকামিতা, সেক্সুয়াল ফ্রাস্টেশন, ডিপ্রেশন, মানসিক অসুস্থতা, অজ্ঞানতা না জানা, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং আইনের শাসনের সংকট এগুলো প্রতিরোধের প্রক্রিয়া শক্তিশালী করাটা এখন সবচে জরুরি। শিশু বুড়োদের বইপত্রে সবার আগে সেক্স এডুকেশনটা দরকার। বাবামারা সন্তানদের বলুক, সন্তান বাবামাকে বলুক। সমাজ নিপীড়নের শিকার নারীটির পাশে সহায় হয়ে দাঁড়াক। এবং সহিংসতা চাপিয়ে রেখে নিজেকে মানসিক ট্রমার ভেতর আটকে না রেখে চিৎকার করে উঠুক কন্ঠগুলো। সেক্স এবিউজ /এডুকেশন নিয়ে বইপত্র হোক, গবেষণা পত্র হোক, একাডেমিক কোর্স থাকুক, ইস্কুলের সাপ্লিমেন্টারি টেক্সট আসুক।